আমাদের বাঙালীর সংস্কৃতিতে খেজুরের গুড় খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য। খেজুরের গুড় খেতেও খুব মজার ও সুস্বাদু। আর শীতের সকালে খেজুরের রস ও মুড়ি মানেই প্রায় অমৃত পাণ। শীতকালে আমাদের গ্রাম বাংলার মেয়েরা খেজুরের গুড় ও রস দিয়ে পায়েস ও বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন পিঠা পুলী ও জিলাপি তৈরি করে থাকেন। শীতকালে আমরা খেজুরের গুড় ছাড়া পিঠা পুলীর কথা ভাবতেও পারি না। খেজুরের গুড়ের স্বাদ ও মানসম্মত এবং পাতালী গুড়, নলেন গুড়, হাজারি গুড় নামে পরিচিত।
রসের জন্য গাছ প্রসস্তুত করনঃ
একটি গাছ পরিপূণ বয়স হলে ধারালো দা দিয়ে গাছের মাথার দিকের বাকল গুলো কাটা হয়। তারপরে ধারালো হাসুয়া দিয়ে চেছে পরিষ্কার করা হয়। এরপরে চাছা স্থানে চুন লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে ছত্রাক না লাগে। এর ৮ থেকে ১০ দিন পরে কাটি লাগানো হয় নাড়ি ঝোলানোর জন্য এবং নলা লাগানো হয় নাড়িতে রস পড়ার জন্য, তার ২ থেকে ৩ দিন পরে খুরপি দিয়ে গাছ লাগানো হয় এবং রস বের হইতে শুরু করে।
১। গাছ লাগানোঃ
খেজুরের গাছ শুধু শীতের মৌসুমে রস দেয় শীত যতো গভীর হয় রস ততোই শু-মিষ্ট ও শু-মধুর হয়। আপনার মন ভালো করার জন্য এক গ্লাস শুমিষ্ট রসই যথেষ্ট, সাথে মুড়ি দিয়ে খেতে আরো মজার ও সুন্দর লাগে। একটি গেছে একটি নাড়ি, খুরপি ও দড়া নিয়ে গাছে উঠে গাছ লাগানোর জন্য এবং গাছ লাগানোর পূর্বে চাছা অংশ টুকু খুব সুন্দর ভাবে পরিষ্কার করে নেয়। এরপরে খুরপি দিয়ে পূর্বের চাছা অংশের মাঝ বরাবর তৃভুজ আকৃতি করে প্রতিদিন চাছা হয় ও এটাকে আমরা গাছ লাগানো বলি। এরপরে কাঠিতে নাড়ি ঝোলানো হয় এবং নাড়িটিকে মশারি দিয়ে সুন্দর ভাবে ঘিরে দেওয়া হয়, যেনো কোনো ধরনের পাখি, বাদুর মুখ না দিতে পারে।
২। রস সংগ্রহঃ
একজন গেছে শীতের ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাউক ও বালতি কাধে ঝূুলিয়েে থর থর করে কাপতে কাপতে রস আহরন করতে মাঠে যায়। এরপরে থর থর করে কাপতে কাপতে ধাপি বয়ে গাছে উঠে এবং মশারি সরিয়ে নাড়িটি সুন্দর ভাবে গাছ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। যখন বৃষ্টি হয় তখন গাছ পিছলে হয়ে থাকে তাই সাবধানে গাছে উঠা-নামা করতে হয়। সাবধানোতার মধ্য দিয়েও অনেক সময় গেছেরা গাছ থেকে পা পিছলে পড়ে যায়। একজন গেছে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আপনাদের জন্য রস সংগ্রহ করে।
৩। রস প্রকিয়া করনঃ
একজন গেছে কনকনে শীতের ভোরে বাউক-বালতি কাধে ঝুলিয়ে নিয়ে গাছের গোড়াই যায়। এবং গাছে উঠে নাড়িটি নিয়ে সুন্দর ভাবে নেমে আসে, তারপরে বালতিতে রস গুলো ঢালা হয়। এবং সব গাছগুলোতে রস সংগ্রহ করার পরে বালতিটি যখন রসে পরিপূর্ণ হয় তখন গেছে বাউকে বালতি বাধিয়ে কাধে ঝুলিয়ে নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে আসার পরে যে ড্রামে রস জ্বাল দেওয়া হবে সেই ড্রামটি সুন্দর ভাবে পরিষ্কার করে নেয়, এবং ড্রামের অপরে ছাঁকনা বসিয়ে রস গুলো ড্রামে ঢালা হয়। এবং রসে যদি কোনো প্রকার ময়লা থাকে তবে সেইটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এরপরে রস জ্বাল করন আঁকা, চুলা, অন্যদিকে বাড়ির অন্য সদস্যরা মাঠে গিয়ে নাড়িগুলো খুব সুন্দর করে পানি দিয়ে মেজে পরিষ্কার করে চুন লাগিয়ে নাড়িটা রেখে দেয়।
৪। খেজুরের গুড় প্রস্তুন করনঃ
একটি গেছে কি ভাবে রসকে গুড়ে পরিণত করে তা নিচে আলোচনা করা হলো, গেছে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে এসে ড্রামের অপরে ছাঁকনা দিয়ে ছাকে। এরপরে শুরু হয় জ্বাল দেওয়া এবং জ্বাল দিতে দিতে এক সময় দেখা যাই রস গুলো ঘন আকার ধারন করে (একে আমরা গ্রামের ভাষায় ফোট ধরা বলে থাকি)। এবং রস আরো একটু ঘন আকার ধারন করলে কিছু পরিমান খাঁটি সরিষার তেল বা ডালডা দেওয়া হয়। এরপরে জ্বালে জ্বালে রসটা আরো ঘন হয়ে যায়। তখন আমরা হাতনা দিয়ে সেই ঘন রস টা নারা-চারা করে থাকি যাতে ড্রামে রসটা লেগে এবং পুরে যেনো না যায়। কিছুখন নারা-চারা করার পরে আঁকার জ্বালটা কমিয়ে দিতে থাকি। এরপরে গুড়টা বড় একটি মাঠির পাত্রে ঢালি সেই পাত্রে কে গ্রামের ভাষায় চাড়ি বলে থাকি (গুড়টা যেনো ঠান্ডা এবং জমে যায় তার জন্য)। এটা আসতে আসতে নারা লাগে , যখন গুড়টা ঠান্ডা হয়ে যায় তখন আমরা গুড়টাকে সারা, ফরমা, পাটালি ইত্যাদি বিভিন্ন আঁকারের জিনিসে ঢেলে থাকি যেনো জমে সেই আকার ধারন করে। এইভাবে আমরা গুড় প্রস্তুত করন করে থাকি।
ঝোলা গুড় প্রস্তুত করনঃ অন্যদিকে ঝোলা গুড় প্রস্তুত করতে হইলে আমরা রস টাকে বেশি ঘন না করে রসটাতে যখন খাঁটি সরিষার তেল বা ডালডা দেওয়ার পরপরি আমরা ঝোলা গুড়টাকে নামিয়ে নি। তখন গরম গুড়টা আমরা মাঠির পাতিলে ঢালি। (গুড়টা যেনো ঠান্ডা এবং জমে যায় তার জন্য এরপরে বোযমে বা মাটির পাএ ড়েলে রাখি
খেজুরের গুড়রের প্রকারভেদঃ
বাংলাদেশে শীতকালীন খেজুরের গুড় একটি অত্যান্ত জনপ্রিয় খাবার। আমাদের বাংলাদেশে বিভিন্ন জেলায় খেজুরের গুড় পাওয়া যায় এবং তা বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রধানত ঝোলা গুড়, চিটা গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, হাজারি গুড়, মুচি গুড় ইত্যাদি জনপ্রিয়। এছাড়াও বিভিন্ন জেলা উপজেলায় অনেক রকমের গুড় পাওয়া যায় যেগুলোর নাম আমাদের অজানা। তবে নাম ভিন্ন ভিন্ন হলেও স্বাদ প্রায় একই রকম।
বাংলা সবংস্কৃতি ও খেজুরের গুড়ঃ
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে খেজুরের গুড় মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য। শীত মানে বাঙ্গালীর পিঠা খাওয়ার উৎসব আর শীতের মৌসুমে খেজুরের গুড় ছাড়া পিঠা খাওয়া অপূর্ণতা থেকে যায়। শীতের সকালে কনকনে ঠান্ডায় খেজুরের রস দিয়ে মুড়ি খাওয়ার মজা আলাদা, খেজুরের রস দিয়ে রান্না করা পায়েস খেলে মনে হয় এর বেশি স্বাদের আর কিছু হয় না। আবার এই সময়ে মানুষের ঘরে নতুন ধান উঠে আর নতুন ধান উঠার সাথে সাথে পিঠার খাওয়া ধুম লেগে যায়। এই সময় মানুষের বাড়িতে মেয়ে জামাই বেরাইতে আসে আর লেগে যাই পিঠা বানানোর পারাপারি। মানুষের ঘরে ঘরে আনান্দ ফুটে উঠে আর হাসির উল্লাসে মেতে উঠে সবাই। আমাদের সংস্কৃতিতে খেজুরের রস ও গুড় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাই বলা যায় আমাদের সংস্কৃতিতে খেজুরের রস ও গুড় বিশেষ ভাবে জড়িত। খেজুরের রস ও গুড় ছাড়া আমদের শীতকালীন সংস্কৃতি অপূর্ণ থেকে যায়।
খেজুরের গুড় এলাকাভৃত্তিক প্রাপ্যতাঃ
স্বাদ ও মন ভরবে খেজুরের গুড়ে, পাটালি গুড়, নলেন গুড়, হাজারি গুড় ও মুচি গুগ, খুড়ি গুড় নামে পরিচিত। বাংলাদেশে মূলত যশোর, ফরিদপুর, নাদিয়া জেলার, বাসিরহাট, সাতক্ষীরা,ও রাজশাহী জেলায় ব্যাপক ভাবে খেজুরের গাছ চাষ বা উৎপাদ করা হতো। ১৯৪০ এর দশকের প্রথমে মেদনীপুর, ফরিদপুর ও রাজশাহী জেলাগুলোতে শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটে। এবং এইগুলো ধীরে ধীরে আরো কিছু জেলায় ছড়িয়ে পরে, ১৯৮০ এর দশকে প্রতি বছর ১লক্ষ্য টন গুড় উৎপাদিত হতো। রাজশাহী মেদনিপুর ও ফরিদপুর এই জেলা গুলোতে এমন কি বর্তমান সময়ে খেজুরের গুড় এই জন্য রাজশাহী জেলাতে জনপ্রিয়।
খেজুর গুড়ের ইতিহাসঃ
অনাদিককাল থেকে বাংলার সংস্কৃতির সাথে খেজুরের গুড় জড়িয়ে আছে। এবং ১৯৪০ এর দশকের দিকে রাজশহী, যশোর, ফরিদপুর, সাতক্ষীরা, বসিরহাট, মেদেনিপুর, রাজশহী, এই জেলা গুলোতে ব্যাপক ভাবে খেজুরের গাছ চাষ ও উৎপাদ হতো। এক বিঘা জমিতে একশটি খেজুরের গাছ লাগানো যায়। এবং গাছ লাগানোর সাত বছর পর থেকে গাছ রস দিতে শুরু করে। এবং ৩৫ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত গাছ রস দেয়। ১৯৪০ এর দশকে উল্লেখিত জেলাগুলোতে তৎকালিন সময়ে ১ লক্ষ টন গুড় উৎপাদিত হতো। তৎকালিন সময়ে পাটালি গুড়, নলেন গুড়, হাজারি গুড় ও মুচি গুগ, খুড়ি গুড় অনেক জনপ্রিয় ছিলো।
খেজুরের গুড় কোথায় পাওয়া যায়ঃ
বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। তাই আমাদের এই দেশে কিছু কিছু জেলায় যথেষ্ঠ পরিমানে খেজুরের গাছ চাষ ও উৎপাদন হয়। এর মধ্যে রাজশাহী জেলা অন্যতম, রাজশাহী জেলাতে যথেষ্ঠ পরিমানে খেজুরের গাছ চাষ ও উৎপাদনের পাশাপাশি যশোর, ফরিদপুর, মেদেনিপুর, বসিরহাট এই জেলাগুলোতে খেজুরের গাছ চাষ করা হয়। এই জেলাগুলোর খেজুরের গুড় বাংলাদেশের সব জেলা গুলোতেই বানিজ্যিক ভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তো আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে খেজুরের গুড় বানিজ্যিক ভাবে পাঠানো হয় কিন্তু খেজুরের রস কেনো পাঠানো হয় না। রস পাঠানো হয় না কারন রস সকালে গাছ থেকে নামানোর ৩ থেকে ৪ ঘন্টার মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। তাই খেজুরের রস বানিজ্যিক ভাবে বন্টন করা হয় না।
খেজুরের গাছ ও গুড়ের বর্তমান পেক্ষাপটঃ
বর্তমান বাংলাদেশের সব জেলাতেই গাছ পালা কেটে ফেলা হচ্ছে যা আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। খেজুরের গাছ খেজুর ও রস দুটোই দেয় কিন্তু কিছু কিছু মানুষ গাছ কেটে ফেলছে। যার কারনে আমাদের দেশে কিছু কিছু জেলাতে খাঁটি গুড়ের পরিমান কমে যাচ্ছে আর এই সুযোগের অপব্যাবহার করে কিছু কিছু মানুষ চিনি ও রং মিশিয়ে দিচ্ছে। যার কারনে গুড়ের আসল স্বাদটা হারিয়ে যাচ্ছে। আপনারাই বলেন ন্যায় টাকা দিয়ে গুড় কিনে খাবো তাহলে চিনি যুক্ত গুড় কেনো খাবো, যদি চিনি যুক্ত গুড় খেতে হয় তাহলে বাজারে থেকে চিনি কিনে খাবো। এজন্যই আমরা উদ্দ্যোগ নিয়েছি আপনাদের দাড়ে দাড়ে হাইড্রজ বা চিনি এবং ভ্যাজার মুক্ত গুড় পৌছে দেওয়ার জন্য।
খেজুরের গুড় নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা/মতামতঃ
ভোক্তা অধিকার রক্ষায় ভোক্তা আইন আরো কঠিন হওয়া উচিত। খেজুরের গুড় আমদের দেশের অন্যতম এবং এটি আমাদের দেশের সংস্কৃতির মধ্যেও পরে তাই খেজুরের গুড়ে ভ্যাজাল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি তাই দেখে শুনে কিনবেন। কিছু মুনাফালোভী ব্যবসায়ী হাইড্রজ (সোডিয়াম হাইড্রসালফাইড) জাতীয় কিছু রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত করে গুড়ের খাদ্য মান বিনষ্ট করছে। আমরা বানিজ্যিক ভাবে ব্যাবসা করার জন্য গুড় তৈরি করিনা। আমাদের কাছে পাচ্ছেন উন্নত মানের এবং ভ্যাজাল মুক্ত খেজুরের গুড়।
পদ টিকাঃ
হাসুয়া আমাদের গ্রাম বাংলায় কিছু জিনিসের আঞ্চলিক ভাষার নাম যেমন আমাদের গ্রাম বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় হাইসি ও কান্তি আবার এইটারি শুদ্ধ ভাষায় হাইসি কে বলি হাসুয়া (sickle) এবং কান্তি কে বলি কাস্তে, তবে হাসুয়া ও কাস্তের মধ্যে মৌলিক গঠনের পার্থক আছে। খুরপি আমাদের দেশের অনেকে খুরপি কে বাটাল এবং বাটাল কে খুরপি হিসেবে চিনেন কিন্তু সেইটা ভুল। খুরপি ও বাটাল নামে যেমন পার্থক তেমন কাজ ও ভিন্ন, আমরা অনেকে অনেক পত্র পত্রিকায় লেখা দেখে থাকি বাটাল ও খুরপি একই কিন্তু সেইটা ভুল লিখেছেন। এবং যেটা দিয়ে খেজুরের গাছ লাগাই সেইটা খুরপি বলে আর যেটা দিয়ে ফার্নিচারে কাঠ কেটে ডিজাইন করা হয় সেইটাকে বাটাল বলে। এবং এই দুটোর ধার তোলার পদ্ধতিও ভিন্ন। খুরপি টা দেখতে একটু চিকন ও লম্বা হয় এবং বাটাল টা দেখতে একটু মোটা ও বেশি লম্বা হয় না।
Authors: Radul, bijoy
Leave a Reply